বাজেট ঘাটতি কাকে বলে ?বিভিন্ন ধরনের বাজেট ঘাটতি (সুষম বাজেট, ঘাটতি বাজেট, উদ্বৃত্ত বাজেট) /ঘাটতি ব্যয়ের প্রভাব /ভারতে ঘাটতি বাজেটের প্রভাব What is budget deficit ?different types of budget deficit/ deficit financing or deficit budget and its effects/ effects of deficit budget in India
বাজেট ঘাটতি কাকে বলে ?বিভিন্ন ধরনের বাজেট ঘাটতি /ঘাটতি ব্যয়ের প্রভাব /ভারতে ঘাটতি বাজেটের প্রভাব
What is budget deficit ?different types of budget deficit/ deficit financing or deficit budget and its effects/ effects of deficit budget in India
![]() |
সাধারণভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাবকে বাজেট বলা হয়। কোন একটি আর্থিক বছরের শুরুতে আগামী এক বছরের মধ্যে সরকারের সম্ভাব্য আয় এবং প্রস্তাবিত ব্যয়ের যে হিসাব সরকার লিখিতভাবে পেশ করে তাই হল বাজেট। আগামী বছরে সরকারের সম্ভাব্য আয় কত হবে এবং কোন কোন উৎস থেকে ওই আয় আসবে তা বাজেটে উল্লেখিত থাকে। আবার আগামী আর্থিক বছরে সরকারের প্রস্তাবিত ব্যয় কত হবে এবং কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করা হবে তাও বাজেটে উল্লেখিত থাকে।
সরকারের আয় এবং ব্যয়ের তুলনার ভিত্তিতে বাজেটকে তিনটা শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। সুষম বাজেট, ঘাটতি বাজেট, উদ্বৃত্ত বাজেট।
যখন বাজেটে প্রস্তাবিত আয় এবং প্রস্তাবিত ব্যয় পরস্পরের সমান হয় তখন তাকে সুষম বাজেট বলে।
যখন বাজেটে প্রত্যাশিত আয় অপেক্ষা প্রস্তাবিত ব্যয় বেশি হয় তখন সেই বাজেটকে ঘাটতি বাজেট বলে।
অন্যদিকে যখন বাজেটে প্রত্যাশিত আয় অপেক্ষা প্রস্তাবিত ব্যয় কম হয় তখন থেকে উদ্বৃত্ত বাজেট বলে।
বাজেট ঘাটতির বিভিন্ন ধারণা
- রাজস্ব ঘাটতি (Revenue deficit)
রাজস্ব খাতে ব্যয় ও রাজস্ব খাতে আয়ের পার্থক্যকে রাজস্ব ঘাটতে বলা হয়। এই রাজস্ব খাতে আয় এর মধ্যে রয়েছে কর রাজস্ব বাবদ আয় ও অ-কর রাজস্ব বাবদ আয়। রাজস্ব খাতে ব্যয় আবার পরিকল্পনা বহির্ভূত ব্যয় অথবা পরিকল্পনাভুক্ত ব্যয় হতে পারে।
- বাজেট ঘাটতি (Budget Deficit)
সরকারের মোট ব্যয় এবং মোট আয়ের মধ্যে পার্থক্য কে বলা হয় বাজেট ঘাটতি। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৮ সালের বাজেট থেকে ভারত সরকার এই বাজেট ঘাটতির ধারণাটির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন।
ফিসকাল ঘাটতি (Fiscal Deficit)
বাজেট ঘাটতির পরিবর্তে এখন ফিসকাল ঘাটতির ধারণাটি ব্যবহার করা হয়। ফিস্কাল ঘাটতি এভাবে হিসাব করা হয় রাজস্ব খাতে সমগ্র আয় এবং মূলধনী খাতের আয়ের মধ্যে পুরাতন ঋণ আদায় এবং অন্যান্য আদাই কে ধরে মোট আয় হিসাব করা হয়। এখন মোট ব্যয় এবং মোট আয় এর পার্থক্য হল ফিসকাল ঘাটতির পরিমাণ। অন্যভাবে বলতে গেলে সরকারের বাড়তি ঋণ এবং অন্যান্য দায় বৃদ্ধি থেকে ঋণ শোধের জন্য বিলগ্নীকরণকে বাদ দিলে ফিসকাল ঘাটতির পরিমাণ পাওয়া যাবে।
প্রাথমিক ঘাটতি (Primary Deficit)
ফিস্কাল ঘাটতি থেকে সুদ প্রদান বাদ দিলে পাওয়া যায় প্রাথমিক ঘাটতি। অতীতে যে ঋণ করা হয়েছে তার ফলস্বরূপ সুদ দিতে হয়।কাজেই সুদ প্রদান বাদ দিলে যে প্রাথমিক ঘাটতি পাওয়া যায় তা বর্তমান বছরের কাজ কর্মের ফলে উদ্ভূত বলে ধরা যেতে পারে।
অর্থসৃষ্টিকারী ঘাটতি (Monetised Deficit)
যদি ঘাটতির ফলে জনসাধারণের হাতে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তবে ওই ঘাটতিকে অর্থ সৃষ্টিকারী ঘাটতি বলে। ধরা যাক সরকার ঘাটতি মেটাবার জন্য রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে ঋণ নিল, রিজার্ভ ব্যাংক অতিরিক্ত নোট ছেপে ওই নোট সরকারের হাতে তুলে দিল। সরকার ওই টাকা খরচ করার ফলে জনসাধারণের হাতে অর্থ যোগ বৃদ্ধি পেল।কাজেই এই ঘাটতি অর্থ সৃষ্টিকারী ঘাটতি।
ঘাটতি ব্যয়ের প্রভাব(Effects of Deficit financing)
সরকারের বাজেটে আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হলে ওই বাজেটকে ঘাটতে বাজেট বলা হয়। সরকারের আয়ের মধ্যে কর ,শুল্ক প্রভৃতির দ্বারা সংগ্রহীত অর্থ এবং সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের লাভ থেকে প্রাপ্ত অর্থকে ধরা হয়।এই ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার জনসাধারণ ,বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে। ভারতের সরকার জনসাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ও ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যে ঋণ সংগ্রহ করে সেই অর্থকে সরকারের রাজস্ব হিসেবে ধরা হয়। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে গৃহীত ঋণকে বাজেটে ঘাটতি হিসেবে ধরা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সরকারকে ঋণ দেয় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নোট ছেপে বেশি অর্থ সরকারের হাতে তুলে দেয় ফলে বাজেটে ঘাটতি হলে সেই ঘাটতির ফলে দেশে অর্থের যোগান বৃদ্ধি পায়।
প্রাচীন অর্থনীতিবিদদের মতে ঘাটতি ব্যয় কখনই বাঞ্ছনীয় নয় কারণ ঘাটতি ব্যয়ের ফলে দেশের অর্থের যোগান বাড়বে এবং অর্থের যোগান বাড়লে সাধারণত দাম স্তর বাড়বে এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে।প্রাচীন অর্থনীতিবিদদের এই বক্তব্য দুটি অনুমানের ওপর নির্ভরশীল ।
প্রথমত , ধরেছিলেন যে দেশে সকল সময় পূর্ণ কর্মসংস্থান বজায় আছে এবং সমস্ত উপকরণের পূর্ণ নিয়োগ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত ,অর্থের পরিমাণ তত্ত্বকে সত্য বলে ধরেছিলেন যদি দেশে উপকরণের পূর্ণ নিয়োগ বজায় থাকে তাহলে উৎপাদন আর বাড়ানো সম্ভব নয়। এই অবস্থায় ঘাটতি ব্যায়ের ফলে অর্থের যোগান বাড়লে দাম স্তর বাড়বে। কাজে ঘাটছি ব্যয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সাহায্য করতে পারে না।
অন্যদিকে অধ্যাপক কেইনস কিন্তু ঘাটতি ব্যায়কে সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে যদি সরকারের বাজেটে ঘাটতি হয় তাহলে দেশের অর্থের যোগান বাড়বে অতিরিক্ত অর্থ জনসাধনার হাতে আয় হিসেবে আসবে। জনসাধারণের আয় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তাদের ভোগ ব্যয় বাড়বে, ফলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়বে। সামগ্রিক চাহিদা বাড়লে গুনক প্রভাবের মাধ্যমে দেশের আয় আরও বৃদ্ধি পাবে। ঘাটতি ব্যয়ের ফলে দেশের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। উদ্বৃত্ত শ্রম ও অব্যব্যবহৃত উপকরণ থাকে তাহলে ঘাটতি ব্যয়ের মাধ্যমে তাদের কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত উৎপাদন করা সম্ভব।
ভারতে ঘাটতি ব্যয়ের প্রভাব
উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় অর্থ সংগ্রহের একটি উপায় হিসেবে ঘাটতি ব্যয় কে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভারতের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাতেও ঘাটতি ব্যয় কে ব্যবহার করা হয়েছে। এর প্রধান কারণ পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য অর্থ পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন সেই পরিমাণ অর্থ কর বসিয়ে বা উদ্বৃত্ত রাজস্ব থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। আবার অনেক সময় বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজনীয় তুলনায় অপ্রতুল হয়। সেজন্য পরিকল্পনার ব্যয়ভার মেটাতে সরকারকে ঘাটতি ব্যয় কেই ব্যবহার করতে হয়।
ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থের যোগান বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদন সেই অনুপাতে বাড়ে না ফলে দাম স্তর বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে ভারতের দাম স্তর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ঘাটতি ব্যয় এর অন্যতম কারণ।
ঘাটতি ব্যয়ের অপর একটি কুফল হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি। অভ্যন্তরীণ দাম স্তর দ্রুত হারে বাড়লে দেশের রপ্তানি কমে আসে ও আমদানি বৃদ্ধি পায়। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ভারতেও এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রমাগত ঘাটতির অন্যতম কারণ ঘাটতি ব্যয় ও তার ফলে উদ্ভূত মুদ্রাস্ফীতি।
পরিশেষে বলা যায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করতে হলে ঘাটতি ব্যয়কে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রিত ঘাটতি ব্যয় অর্থনীতির পক্ষে শুভ হলেও লাগামহীন ঘাটতি ব্যয় অর্থনীতিতে অভিশাপ ডেকে আনে। মুদ্রাস্ফীতিকে দমন করতে হলে ঘাটতি ব্যয় অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
